বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে দামি জিনিস হলো সময়। সময়কে যারা ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে, তাদের সাফল্যে অন্যরা মুগ্ধ হয়। সময় ব্যবস্থাপনা মানুষের নিত্যদিনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাত্যহিক জীবনে কোনো কাজ শুরু করার পর সেটিতে বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখা খুব কঠিন হয়ে যায়।
অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট করতে করতে যখন দেখা যায় আসল কাজটাই করা হয়নি, তখন স্বাভাবিকভাবেই নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস অনেকখানি কমে যায়। এর ফলে কাজের পাহাড় যেমন জমে, তেমনি বেড়ে যায় মানসিক চাপ আর কমে যায় উৎপাদনক্ষমতা। প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে সময়মতো কাজ জমা দিতে না পারার জন্য বসের বকুনি খেতে হয়। এমন সমস্যা এক–দুটি নয়, অনেক রয়েছে। এর কি কোনো সমাধান নেই?
অবশ্যই এর অনেক রকম সমাধান রয়েছে। তবে বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতিটির নাম পোমোদোরো মেথড (Pomodoro Technique)। এটি সময় ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বৈপ্লবিক কৌশল বলা যায়। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে মনোযোগ ধরে রাখা অনেক সহজ হয়। সহজ করে বললে, পোমোদোরো মেথডে নির্দিষ্ট সময় ধরে একটি কাজ করা হয়, এরপর ছোট বিরতি নিয়ে আবার কাজে ফিরে আসা হয়। কাজটি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে।
পোমোদোরো মেথডের জন্ম ইতিহাস
পোমোদোরো মেথডের আবিষ্কারক ইতালিয়ান উদ্যোক্তা ও লেখক ফ্রান্সেসকো সিরিলো (Francesco Cirillo)। ১৯৮০–এর দশকের শেষের দিকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পড়াশোনার সময় মনোযোগ ধরে রাখতে এবং সময় সঠিকভাবে ব্যবহার করতে তিনি রান্নাঘরের টমেটো আকৃতির টাইমার ব্যবহার করতেন। ইতালীয় ভাষায় টমেটোকে বলা হয় Pomodoro। সেই টমেটো–আকৃতির টাইমারের নাম থেকেই এ কৌশলের নামকরণ হয় “Pomodoro Method”।
প্রথমে সিরিলো ঠিক করেন ২৫ মিনিট ধরে একটানা পড়াশোনা করবেন, তারপর ৫ মিনিট বিরতি নেবেন। তিনি দেখলেন, এইভাবে পড়াশোনা করলে ক্লান্তি কম হয়, মনোযোগ দীর্ঘ সময় টিকে থাকে এবং কাজ দ্রুত সম্পন্ন হয়। পরে তিনি এই অভিজ্ঞতাকে একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতিতে রূপ দেন, যা আজ সারা বিশ্বে লাখো মানুষ ব্যবহার করছে।
পোমোদোরো মেথডের মূল নিয়মগুলো
১. প্রথমে ঠিক করে নিন কাজটি—যেমন অ্যাসাইনমেন্ট লেখা, বই পড়া, কোডিং, প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরি ইত্যাদি।
২. এরপর একটি টাইমার সেট করে নিন। সময়সীমা হবে ২৫ মিনিট।
৩. এই ২৫ মিনিট পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে কাজ করুন। অন্য কোনো কিছুতে মনোযোগ সরানো যাবে না—ফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা মনোযোগ নষ্ট করে এমন কিছুই নয়।
৪. ২৫ মিনিট শেষ হলে একটি ছোট বিরতি নিন। বিরতির সময়সীমা হবে ৫ মিনিট। এর মধ্যে হাঁটাহাঁটি করা, পানি পান করা বা গভীর শ্বাস নেওয়া যেতে পারে।
৫. এভাবে চারটি পোমোদোরো সেশন শেষ হলে একটি দীর্ঘ বিরতি নিতে হবে। অর্থাৎ ২৫×৪ = ১০০ মিনিট কাজ + বিরতি শেষ হলে ১৫–৩০ মিনিটের একটি বড় বিরতি নিতে হবে।
এইভাবে কাজ করলে একদিকে কাজ দ্রুত শেষ হয়, অন্যদিকে মস্তিষ্ক সতেজ থাকে এবং ক্লান্তি জমতে পারে না।
পোমোদোরো মেথডের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর সরলতা। মাত্র একটি টাইমার আর কাজের ইচ্ছা থাকলেই যে কেউ এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারে। তাই বলা যায়, ব্যস্ততার এই যুগে পোমোদোরো মেথড শুধু একটি সময় ব্যবস্থাপনার কৌশল নয়, বরং এটি একটি জীবনদর্শন, যা আমাদের কাজের ধারা পরিবর্তন করতে পারে এবং প্রোডাক্টিভ জীবন গঠনে সহায়তা করতে পারে।