ভূমিকম্প কিভাবে আগেভাগে টের পায় কুকুর–বিড়াল–পাখিরা

 
 
মানুষের সবচেয়ে প্রাচীন কৌতূহলের একটি হলো—পশুপাখি কি সত্যিই আগেভাগে ভূমিকম্প টের পায়? ইতিহাস বলে, বড় কোনো ভূমিকম্পের আগে মানুষের চোখে প্রথম যে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে, তা প্রায়ই প্রাণীদের আচরণে। কোথাও পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে বাসা ছেড়ে উড়ে যায়, কোথাও কুকুর হঠাৎ চিৎকার করতে শুরু করে, আবার কোথাও শান্তস্বভাবের বিড়াল অস্থির হয়ে পড়ে। কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক ঘণ্টা আগে পর্যন্ত এমন ঘটনার শতশত বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে এ আচরণ কি কল্পনাজনিত? নাকি এর পেছনে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা আছে?
গবেষণার সারসংক্ষেপ বলছে—প্রাণীরা মানুষের আগে ভূমিকম্প টের পায়, এমন ঘটনাকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেওয়ার মতো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। আবার, একে নিশ্চিত ‘পূর্বাভাস’ বলার মতো শক্ত প্রমাণও পাওয়া যায়নি। কিন্তু বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা ইঙ্গিত দেয়, প্রাণীদের কিছু ইন্দ্রিয় মানুষের তুলনায় অনেক সূক্ষ্ম, যা ভূমিকম্পের আগাম সংকেত শনাক্ত করতে সক্ষম হতে পারে।

P-wave: যে কম্পন মানুষ টের পায় না
 
ভূমিকম্পের মূল ধাক্কা যে S-wave বা শিয়ার ওয়েভ তৈরি করে, তার আগেই পৃথিবীর ভূত্বকে সৃষ্টি হয় P-wave—এক ধরনের উচ্চগতির, কম শক্তির সিসমিক তরঙ্গ। এই প্রথম তরঙ্গ এতটাই সূক্ষ্ম যে মানুষ প্রায় কখনোই তা বুঝতে পারে না। কিন্তু কুকুর, বিড়াল, এমনকি ইঁদুরের মতো প্রাণীর পায়ের নীচের কম্পন শনাক্তকারী রিসেপ্টর অত্যন্ত সংবেদনশীল। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের কয়েকটি গবেষণায় দেখা যায়, প্রাণীরা ভূমিকম্পের কয়েক সেকেন্ড আগে অস্বাভাবিক আচরণ করেছে; যা P-wave শনাক্ত করার ফলাফল হতে পারে।
এ আচরণ হতে পারে দৌড়ে লুকিয়ে পড়া, হঠাৎ চিৎকার করা, জড়সড় হয়ে যাওয়া কিংবা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া। কখনো কখনো তারা পরিবারের সদস্যদের কাছে এসে অস্থিরভাবে ঘোরাফেরা করতে থাকে—যেন সতর্ক করতে চাইছে।

ইনফ্রাসাউন্ড: মানুষের কানে অশ্রব্য, প্রাণীর কানে তীক্ষ্ণ
 
মানুষ সাধারণত ২০ হার্জ থেকে ২০ কিলোহার্জ পর্যন্ত শব্দ শুনতে পারে। ভূমিকম্পের আগে পৃথিবীর গভীরে যে চাপ সঞ্চয় হয়, তার ফলে সৃষ্টি হয় ইনফ্রাসাউন্ড—২০ হার্জের নিচের কম্পাঙ্কের শব্দ। মানুষের কানে এই তরঙ্গ অশ্রব্য, কিন্তু কুকুর, হাতি, পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণী তা স্পষ্ট শুনতে পায়।
২০১১ সালের জাপান ভূমিকম্পের আগে অসংখ্য পাখি বাসা ছেড়ে আকাশে ওঠে গিয়েছিল। একই সময়ে বেশ কিছু শহরের কুকুর একযোগে চিৎকার করতে শুরু করেছিল। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, ভূমিকম্পের পূর্ববর্তী ইনফ্রাসাউন্ডই তাদের আচরণ বদলে দিয়েছিল।
পাখির ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল। পাখির ম্যাগনেটোরিসেপশন ক্ষমতা—চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তন অনুভব করার ক্ষমতা—ভূমিকম্পের আগের মৃদু ইলেকট্রোম্যাগনেটিক অস্থিরতা শনাক্ত করতে পারে। ভূমিকম্পের আগের রাতেই কখনো পাখিরা বাসা ছেড়ে দূরে উড়ে যায়, যা মানুষের নজরে আসে।

ইলেকট্রোম্যাগনেটিক অস্বাভাবিকতা
 
ভূমিকম্প তৈরি হওয়ার ঠিক আগে শিলাস্তরে চাপ জমে এবং ইলেকট্রন-মুক্ত চার্জ উৎপন্ন হয়। এতে বাতাসে অদৃশ্য ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পরিবর্তন তৈরি হয়। মানুষ তা অনুভব করতে না পারলেও কিছু প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্র এর প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল।
বিশেষ করে বিড়াল—তাদের গোঁফের (vibrissae) গোড়ায় থাকা রিসেপ্টরগুলো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পরিবর্তন ও ক্ষুদ্র কম্পনের প্রতি অস্বাভাবিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল। এ কারণেই বিড়ালদের মধ্যে ভূমিকম্পের আগে অস্বাভাবিক ভয়, পালানোর প্রবণতা বা এলোমেলো দৌড়ঝাঁপ দেখা যায়।

প্রকৃতির সূক্ষ্ম পরিবেশগত পরিবর্তন
 
যে অঞ্চল দিয়ে সক্রিয় ফল্ট লাইন গেছে, ভূমিকম্পের আগে সেখানে কিছু প্রাক্-পরিবর্তন দেখা যেতে পারে—
– মাটির ওপরে রেডন গ্যাস নিঃসরণ
– বায়ুর আর্দ্রতায় হঠাৎ পরিবর্তন
– পাথুরে এলাকায় অতিমৃদু গন্ধ
– মাটির উষ্ণতায় সামান্য ওঠানামা
এগুলো মানুষ চোখে–কানে বুঝতে না পারলেও বহু প্রাণী দ্রুত শনাক্ত করতে পারে। বিশেষ করে সাপ, ইঁদুর, পোকামাকড়ের মতো প্রাণীরা ভূ-কম্পন ও রাসায়নিক পরিবর্তনে খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়।

বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি 

মানবসভ্যতার হাজার হাজার বছর আগের পৃথিবীতে প্রাণীদের টিকে থাকার জন্য দ্রুত বিপদ শনাক্ত করা ছিল মৌলিক শর্ত। বন্য পরিবেশে বজ্রপাত, ঝড়, বন্য প্রাণীর আক্রমণ, কিংবা ভূত্বকের নড়াচড়া—এসবের সামান্য আভাও প্রাণীদের বেঁচে থাকার প্রবৃত্তিতে জায়গা পায়। তাই শুধু সিসমিক তরঙ্গ নয়, পরিবেশে আচমকা নীরবতা, মাটির দোল, বাতাসের গতি ইত্যাদি থেকেও তারা বিপদ অনুমান করতে পারে।
চীনের ১৯৭৫ সালের হাইচেং ভূমিকম্পের আগের রাতে শহরের বাসিন্দারা লক্ষ্য করেন—অসংখ্য সাপ শীতের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে, গরু–ছাগল অস্থির আচরণ করছে, আর পাখিরা বাসা ছেড়ে উড়ছে। এ ঘটনায় বিজ্ঞানীরা প্রাণীর আচরণ ও ভূমিকম্পের সম্পর্ক নিয়ে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

তাহলে কি প্রাণীরা ভূমিকম্প ‘পূর্বাভাস’ দিতে পারে?
 
বিজ্ঞান এখনো ‘পূর্বাভাস’ শব্দটি ব্যবহার করতে সতর্ক। কারণ,
১. সব ভূমিকম্পের আগে এ রকম আচরণ দেখা যায় না।
২. অনেক সময় এসব আচরণ অন্য বিপদ, আবহাওয়া, আতঙ্ক বা অন্য উদ্দীপনাতেও হতে পারে।
৩. প্রমাণগুলো বেশিরভাগই পর্যবেক্ষণভিত্তিক, নিয়ন্ত্রিত গবেষণা নয়।
তবে বহু বাস্তব ঘটনার ধারাবাহিকতা বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে। ইতালির Cameron et al. (2019) নামে একটি গবেষণায় দেখা যায়—একটি খামারের গরু, ঘোড়া ও কুকুর ভূমিকম্পের কয়েক ঘণ্টা আগে অস্বাভাবিকভাবে অস্থির হয়েছিল। গবেষকরা খামারে সেন্সর বসিয়ে প্রাণীর আচরণ বিশ্লেষণ করে দেখেন, এই অস্বাভাবিকতা ভূমিকম্পের পূর্ববর্তী ভূগর্ভস্থ চাপ পরিবর্তনের সঙ্গে মিল রেখেছে।
এমন আরও অনেক গবেষণা ইঙ্গিত দেয়—পূর্বাভাস হয়তো বলা যাবে না, কিন্তু প্রাণীরা ভূমিকম্পের প্রাক্-পরিবর্তন অনুভব করতে পারে।

প্রাণীরা ভূমিকম্প আগেভাগে টের পায়—এ ধারণা শুধুই লোককথা নয়। বৈজ্ঞানিকভাবে নিশ্চিত উত্তর এখনও না থাকলেও, প্রাণীদের অতিসংবেদনশীল ইন্দ্রিয়, প্রাক্–কম্পন শনাক্ত করার ক্ষমতা, এবং পরিবেশগত পরিবর্তন বুঝতে পারার দক্ষতা তাদেরকে মানুষের অনেক আগে সতর্ক হতে সহায়তা করে।
তাদের আচরণের এই অস্বাভাবিকতা যদি বৈজ্ঞানিকভাবে নিয়মিতভাবে নথিভুক্ত করা যায়, তবে ভবিষ্যতে ভূমিকম্প সতর্কতা ব্যবস্থায় এ তথ্য ভূমিকা রাখতে পারে।




 

Previous Post Next Post