পাতি মাছরাঙা: বাংলাদেশের জলাশয়ের সৌন্দর্য



আমাদের দেশের খুব পরিচিত একটি দৃশ্য নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের ধারে কোন গাছের ডালে ছোট্ট একটি পাখি গভীর ধ্যানে বসে আছে। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে পানির দিকে। যখনই ছোট কোন মাছ পানির উপরে ভেসে উঠতে দেখা গেলো অমনি তীরের বেগে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাখিটি। উঠে আসার পর দেখা যায় পাখিটার ঠোঁটের ফাঁকে ছোট্ট মাছটি আটকে আছে। আরাম করে মাছটি গলধঃকরণ করে আবার আগের মতোই ধ্যানে বসে যায় পাখিটি। এই পাখিটি আমাদের খুবই পরিচিত পাতি মাছরাঙা।

বাংলাদেশে মোট ১২ রকমের মাছরাঙার দেখা পাওয়া যায়। এরমধ্যে সারাদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পাতি মাছরাঙা পাখিটিকেই। রঙিন এই পাখিটি ছোট মাছরাঙা হিসেবেও পরিচিত। ইংরেজিতে এদেরকে ডাকা হয় Common Kingfisher নামে। আর বৈজ্ঞানিক নাম Alcedo atthis ।

পাতি মাছরাঙা ছোট আকারের মৎস্যশিকারী পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখি লম্বায় ১৬-১৭ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। এদের ওজন ৩৪-৪৬ গ্রাম পর্যন্ত হয়। অপূর্ব সুন্দর দেখতে এই পাখিটির মাথা দেহের তুলনায় আকারে বড় হয়। পেটের রঙ গাঢ় লাল। এছাড়া সারাদেহ নীল রঙের হয়। গলার দিকটায় সাদা। কমলা রঙের কান। মাথার চাঁদি, কাঁধ-ঢাকনি ও ডানা ফ্যাকাসে সবুজাভ-নীল। দুই ডানার বিস্তৃত আকার ২৫ সেন্টিমিটার অবধি হয়। কালো রঙের লম্বা, ধারালো ও চোখা আকৃতির শক্ত ঠোঁট মাছ শিকারের প্রধান অস্ত্র। পাতি মাছরাঙার পা খাটো আকৃতির হয়। লেজও দেহের তুলনায় বেশ ছোটই। বেশিরভাগ মাছরাঙার দেহ উজ্জ্বল রঙের হয়ে থাকে। পাতি মাছরাঙার স্ত্রী ও পুরুষ প্রজাতির মধ্যে দৈহিক পার্থক্য খুব বেশি নয়।

সাধারণত স্বচ্ছ ও স্থির জলাশয়ের আশেপাশেই থাকতে বেশি পছন্দ করে মাছ শিকারী ক্ষুদে এই পাখিটি। ছোট ঝোপঝাড় কিংবা গাছের নিচু ডালে ধৈর্য ধরে বসে থাকতে দেখা যায় এই পাখিটিকে। এদের শিকারের তালিকা দীর্ঘ হলেও প্রধানতম শিকার হচ্ছে ছোট মাছ। এছাড়াও জলজ পোকামাকড়, ব্যাঙ, ক্ষুদ্র সরীসৃপ শিকার করে থাকে পাতি মাছরাঙা।

ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত পাতি মাছরাঙার প্রজননকাল। এই সময় এরা জোড় বেঁধে একত্রে থাকে। জলাশয়ের খাড়া পাড়ে সাধারণত নিরাপদ জায়গায় এরা গর্ত করে বাসা বানায়। স্ত্রী এবং পুরুষ একত্রে মিলে বাসা তৈরি করে। বাসা বানানো শেষে চকচকে সাদা রঙের ৫-৭টি ডিম পাড়ে স্ত্রী পাতি মাছরাঙা। দিনের বেলায় পুরুষ-স্ত্রী মিলেই ডিমে তা দেয়, তবে রাতে শুধু মা পাখিকেই তা দিতে দেখা যায়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০ দিন। ছানার যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রেও স্ত্রী-পুরুষ একত্রেই দায়িত্ব পালন করে। ২৫-২৬ দিনেই ছানা স্বাবলম্বী হয়ে যায়।

প্রকৃতির বাস্তুসংস্থান টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে পাতি মাছরাঙার অবদান অনেক। অসুস্থ এবং রোগবাহী মাছ খেয়ে এই পাখি মৎস্য সম্পদের অনেক উপকার করে থাকে।

পাতি মাছরাঙা বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও ইউরেশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। তবে বাংলাদেশে এটি ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হলেও উপযুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে এখন আর সহজেই চোখে পড়ে না অনিন্দ্য সুন্দর পাখি পাতি মাছরাঙা।
Previous Post Next Post